কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় রোমাঞ্চকর এবং সংগ্রামী। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, ও সমাজকর্মী ছিলেন। নজরুলের সাহিত্যকর্ম ও জীবনাদর্শ্য বাংলার সমাজে অসাধারণ প্রভাব ফেলেছে এবং তিনি "বিদ্রোহী কবি" হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম ২৪ মে, ১৮৯৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। শৈশব থেকেই নজরুল ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাধর এবং সাহসী। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নজরুলের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক বাধা সৃষ্টি হয়েছিল, তবে তা তাঁকে থামাতে পারেনি। তিনি মক্তব, মাদ্রাসা এবং বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং একসময় মক্তবের শিক্ষক হিসেবে কাজও করেন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এসময় তিনি মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) এবং কারনেল যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করেন। সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং সেনাবাহিনীতে তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় গভীর প্রভাব ফেলে।

নজরুলের সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে বিখ্যাত দিক হল তাঁর বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতা "বিদ্রোহী" তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। এই কবিতায় তিনি সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ এবং অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রবল বিদ্রোহ প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি "অগ্নিবীণা", "ভাঙার গান", "সাম্যবাদী", "প্রলয় শিখা" ইত্যাদি কবিতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির কথা বলেছিলেন। নজরুলের গানে এবং কবিতায় হিন্দু-মুসলিম একতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর রচিত ইসলামী গান এবং গজল বাংলার মুসলিম সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাশাপাশি, নজরুল হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছেন, যা হিন্দু সমাজেও সমানভাবে সমাদৃত।


কাজী নজরুল ইসলাম একজন সক্রিয় সাংবাদিক ছিলেন এবং তিনি "দুঃখিনী বাংলা", "ধূমকেতু", "লাঙ্গল" এবং "গণবাণী" পত্রিকায় কাজ করেছেন। এই পত্রিকাগুলিতে তাঁর লেখায় তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তির আহ্বান করেছেন। নজরুল তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং কর্মসূচির জন্য বারবার কারাবরণ করেন। ১৯২৪ সালে কাজী নজরুল ইসলাম প্রমীলা দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের চার সন্তান ছিল। নজরুলের জীবনের শেষ পর্বে তিনি পারকিনসনস ডিজিজে আক্রান্ত হন, যা তাঁর স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশে নিয়ে আসে এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়। ১৯৭৬ সালে ২৯ আগস্ট ঢাকায় এই মহান কবির জীবনাবসান ঘটে।

কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভা হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা, গানের সুর, এবং সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর সৃষ্টি বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে গেঁথে আছে এবং তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুক্তি এবং সমতার প্রতীক হয়ে থাকবেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post